সেদিন হঠাৎ করেই প্রাক্তনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে যেন কোথা থেকে সামনে এসে পড়লো। প্রায় পাঁচ বছর পর তাকে এভাবে দেখবো—ভাবতেই পারিনি। মনের কোণে যে বন্ধ বাক্সটা এতদিন ধুলো জমে পড়ে ছিল, সেটা যেন আচমকা খুলে গেল। মনে পড়ে গেল, কতটা নির্মমভাবে একা ফেলে চলে গিয়েছিল সে।
তখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। ক্লাস শেষে বান্ধবীরা মিলে ঠিক করলো রেস্টুরেন্টে যাবে। আমার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেল সবাই। রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওরা খাবারের মেন্যু দেখছে, আর আমি হঠাৎ কর্ণারে রাজকে দেখে চমকে উঠলাম। একটা মেয়ের সঙ্গে হাতে হাত রেখে, কাঁধে মাথা রেখে গল্প করছে সে। মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো। নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।
তার নাম্বারে কল দিলাম। কল কেটে দিয়ে মেসেজ করলো—
“আমি মিটিংয়ে আছি। মিটিং শেষ হলে কল দেবো।”
চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সঙ্গে দেখে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নিজেকে সামলে নিলাম। এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে চলবে না। ফোনটা হাতে নিয়ে রাজ আর পাশে বসে থাকা মেয়েটার কয়েকটা ছবি আর ভিডিও করলাম। মাথা ব্যথা হচ্ছে বলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। রাগে, দুঃখে, নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হলো।
কোনোরকমে বাসায় পৌঁছে ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা শাওয়ার নিলাম। বেরিয়ে দেখি রাজের কল—
“হ্যালো সোনা! কী করছো? শুয়ে আছি। আচ্ছা শোনো, আমার মাথা ব্যথা করছে। এখন রাখছি। ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি—তুমি কাল আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে? জো হুকুম মহারানী! আচ্ছা, বাই!”
সকাল ১১টায় রাজের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি সে এসে বসে আছে।
— কেমন আছো রাফা?
— হুম, ভালো আছি।
— আচ্ছা রাজ, তুমি আমায় কতটা ভালোবাসো?
— হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করছো? কী হয়েছে?
— জানো রাজ, আমি মিথ্যে বলা পছন্দ করি না। সত্যি বলো তো, তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো?
— কী বলছো এসব তুমি?
— যা জিজ্ঞেস করলাম, তার উত্তর দাও।
— না, তুমি ছাড়া অন্য কারো দিকে আমি তাকাই না। তুমি আজ এসব কথা কেন বলছো? কী হয়েছে তোমার?
— আচ্ছা, এই ছবি আর ভিডিওগুলো দেখো তো, কিছু মনে পড়ে কি না?
— এসব তুমি কোথায় পেলে? বিশ্বাস করো, এসব এডিট করা। তোমায় কে পাঠিয়েছে বলো?
— আমার নিজের হাতে তোলা, নিজের চোখে দেখা। কেউ কিছু পাঠায়নি। সত্যিটা বলো প্লিজ।
— না মানে… আসলে তুমি যখন সব জেনে গেছো, তখন লুকিয়ে কী লাভ! রাফা, আমি অনন্যাকে ভালোবাসি। তোমার প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই। তুমি স্মার্ট না, কেমন একটা সেকেলে। কিন্তু অনন্যা খুব সুন্দরী, স্মার্ট। আমি ওর সঙ্গে থাকতে চাই।
— এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত?
— হ্যাঁ। আমি এখন যাই। অনন্যা অপেক্ষা করছে। তুমি নিজের মতো নতুন করে জীবনটা সাজিয়ে নিও। আমায় কল বা মেসেজ করো না। ভালো থেকো।
সেদিনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অন্য শহরে পাড়ি জমাই। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দিই। পাঁচ বছর পর প্রমোশন পেয়ে আবার এই শহরে ফিরে আসি।
“রাফা… এই রাফা!”
রাজের ডাকে অতীত থেকে ফিরে এলাম।
— আমায় তুমি মাফ করে দাও রাফা।
সেদিন অনন্যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখি, একটা ছেলের সঙ্গে বসে আছে। পরে জানলাম, ওই ছেলেটাই অনন্যার বয়ফ্রেন্ড। কিছুদিন পর ওদের বিয়ে। আমি তোমায় অনেক খুঁজেছি। তোমার বান্ধবীদের কাছে হন্যে হয়ে ঘুরেছি। কিন্তু কেউ তোমার খোঁজ দেয়নি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। প্লিজ, আমায় ক্ষমা করে আরেকটা সুযোগ দাও। আমি আর তোমায় কষ্ট দেবো না।
আমি কিছু বলতে যাবো, তখনই—
— মাম্মা, মাম্মা! তালাতালি আতো! লেট হয়ে যাত্তে তো!
— বাবাই, মাম্মাতে বলো না তালাতালি আততে!
“আসছি বাবা!” বলে গাড়িতে উঠে পড়লাম। তখনই আমার স্বামী রাফসান বলে উঠলো—
— দেখেছো রাফুরানী, প্রকৃতি মানুষকে ছাড় দেয়, কিন্তু ছেড়ে দেয় না। একেই বলে Revenge of Nature।
Leave a Reply