“নিশিকন্যা”

নিশিকন্যা গল্প

ইদানীং রাতে ঠিকমত ঘুম হয়না, তাই রাত হলেই মেস থেকে বের হয়ে যাই বাইরে হাটার উদ্দেশ্যে।

কয়েক দিন যাবত হেটে হেটে পার্কের এই কদম গাছটার নিচের বেঞ্চে এসে বসি।

আজেও সেখানেই এসে বসেছি।

কিন্তু হঠাৎ…

-বসতে পারি?

একটা মেয়েকন্ঠের আওয়াজ পেয়ে চমকে তাকালাম।

দেখি আমার পাশে একটা মেয়ে একমনে বসে নিজের পার্স খুটখাট করছে। কথাটা কাকে বলল বুঝতে পারলাম না। আশেপাশেও কোন মানুষ দেখছি না। এখন রাত প্রায় ১টার কাছাকাছি। মেয়েটার দিকে খেয়াল করলাম। পার্কের ল্যাম্পপোষ্টের হালকা আলোয় তাকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দরী মনে হচ্ছে।

মনে হচ্ছে আকাশ থেকে কোন পরী মাটিতে নেমে এসেছে এবং তার ডানাদুটি খুলে রেখে দিয়েছে ।

– কি দেখেন?

(মেয়েটির কথায় আমি থতমত খেয়ে গেলাম। একটু অস্বস্তির মাঝে পড়ে গেলাম। মেয়েটি আবার অন্যকিছু ভেবে বসলে সমস্যা)

এই রাত বিরেতে, জনাকীর্ণ পার্কে একটা মেয়ে আর আমি একা। দূরে অবশ্য কিছু কিছু মানুষজন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানে কেউ নেই। ভয় পাচ্ছি এই ভেবে এখনকার যুগে ইভটিজিং এর কেইস খুব মারাত্নক। যদি না আবার ইভটিজিং কেসে ফেসে যাই।

মেয়েটি আবার বলল- চলবে?

এবার বুঝলাম আসল ঘটনা। সে অন্য সব সাধারণ মেয়ে নয়, সে নিশিকন্যা। যেহেতু আমার রাতবিরাতে হাটা চলার করার অভ্যাস আছে সে সুবাদে এর আগেও আমি অনেক দেখেছি নিশিকন্যা, কিন্তু এতটা সুন্দরী কখনোই দেখি নাই।

আজ হঠাৎ কেন জানি, আমার নিশিকন্যার প্রস্তাবে সায় দিতে ইচ্ছে হল।

আমি বললাম- হুম।

– ২০০ টাকা লাগবে কিন্তু। পরে গিয়ে বলবে যে টাকা নাই তা হবেনা।

– হুম, আছে।

– আপনে নিয়া যাবেন, না আমার জায়গায় যাবেন?

– আমার জায়গা নাই। আপনার জায়গাতেই চলেন।

– আসেন আমার সাথে। রিক্সাভাড়া আছে?

– থাকতে পারে। দেখে নিব?

– দেখে নিবেন নাতো কি করবেন। পকেটের টাকার খবরও জানেন না?

ইদানিং একটা রোগে ভুগছি। “শর্ট টাইম মেমোরি লস”। হয়ত অধিক টেনশন করার কারণে এই সমস্যা।

কিছুক্ষণ আগেও দেখেছিলাম পকেটে কত টাকা আছে, কিন্তুএখনি ভুলে গেছি।

পকেট হাতরে ৩৫২ টাকা পেলাম। রিক্সায় ওঠার আগে নিশিকন্যা একটা চুয়িং গাম মুখে পুড়ল। আর একটা আমার দিকে বারিয়ে দিলো। আমি একটু অবাক হলাম। আমি জানতাম নিশিকন্যারা পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে। কিন্তু এখানে তার ব্যাতিক্রম। আসলে ব্যাতিক্রম জিনিশ গুলি আমাদের কাছে অনেক বেসি ইন্টারেস্টিং মনে হয়। আর তাতেই আমরা বেসি আগ্রহী হয়ে থাকি।

যেমন, আজকে আমি হয়েছি। জীবনে কখনও পতিতালয়ে যাইনি। আজ কেন জানি, খুব যেতে ইচ্ছে হল।

মানুষের মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব ইচ্ছা জাগে। যেমনটা আজকে আমার জেগেছে।

এখন আমি নিশিকন্যার ঘরে। নিশিকন্যার ঘরটা খুব গোছালো। আমি খাটের উপর বসে আছি। মেয়েটির মুখ থেকে মায়াবী ভাবটা চলে গেছে। হয়তো আলোর কারণেই মায়ার জায়গায় নিষ্ঠুরতা চেপে বসেসে।

আবার হয়তো সমাজের নিষ্ঠুরতা নিজের করে নিয়েছে।

আমার আবার একটা আদ্ভুত ইচ্ছে হল, মেয়েটির নাম ধরে ডাকার ইচ্ছা। নাম জিজ্ঞেস করব কিনা ভাবছি।

না থাক, কি দরকার!

মেয়েটি হঠাৎ বলল- বসে আছেন ক্যান?

– আপনার নাম কি?

– ঢং কইরেন না। তারাতারি কাজ শেষ করে চলে যান।

আমি বসেই আছি। বসে থাকতে ভালো লাগছে। নিশিকন্যাও আমার পাঁশে বসে আছে। আমার খুব পানির পিপাসা পাচ্ছে। নিশিকন্যাকে পানি আনতে বলব। কিন্তু কি বলে সম্বোধন করব তা বুঝতে পারছিনা।

“দেবদাস” এর সেই নিশিকন্যার নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু নামটা মনে পড়ছে না। শর্ট টাইম মেমোরি লসের প্রভাব। কতক্ষণ হল বুঝতে পারছিনা। কিন্তু আমি বসেই আছি। পানির পিপাসা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। পিপাসা নিয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।

আমি নিশিকন্যাকে পানি দিতে বল্লাম।

কিন্তু ও বলল- আপনার সময় শেষ। বাইরে গিয়ে পানি খান।

আমি কিছু না বলে টাকা দিলাম। ও নির্লিপ্ত ভাবে টাকাটা নিয়ে নিল, যেন এটাই সাভাবিক।

আজকে কত তারিখ? কি বার? কিছুই মনে পরছেনা।

আজ অনেক দিন ধরেই “শর্ট টাইম মেমোরি লস” এই রোগটায় ভুগছি।

হঠাৎ…

-আজকেও বসে আছেন এখানে?

গলাটা শুনেই চিনতে পারলাম এটা সেই নিশিকন্যার।

আমি সরাসরি বললাম, আজকে ২০০ টাকা নাই। ৫০ টাকা কম আছে মনে হয। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-চলেন। দীর্ঘশ্বাসটা তার ৫০ টাকা লসের জন্য, নাকি আমার অযথা টাকা অপচয়ের সেটা বুঝলাম না।

আজ অষ্টম দিন। এখনও নিশিকন্যার নাম জানা হয়নি। নিশিকন্যা অনেক কঠিন মেয়ে। এই কয়দিন নিয়মিত নিশিকন্যার বাসায় গিয়েছি। ধীরে ধীরে তার সব কথা শুনেছি। কখনও আমি নিজে থেকে কিছুই বলিনি। সে বলেছে আর মুগ্ধ হয়ে সে কথা শুনে গেছি। আসলে আমি কখন কারো কথা এতো মন দিয়ে শুনিনি।

তাছাড়া, আমি কখন কারো কথা শুনে মনের ভীতর বেথ্যা অনুভব করিনি। তবে ওর কথা শুনে মনটা তিক্ততায় ভরে গেছে। চোখের কোনে জল এসেছে পরেছে নিজের অজান্তেই। কেন? এর কারন কি? কিছুই বুঝলাম না। থাক এই না জানা রহস্যটা।

এখন রাত প্রায় ২টা। আজও পার্কের বেঞ্চে বসে আছি আর ভাবছি, সমাজের বর্তমান কর্মের কাছে নিশিকন্যার কর্মটাও আমার কাছে ভালো মনে হল।

আমাদের সমাজে আমাদেরেই প্রকাশ্যে অথবা চোখের আড়ালে যে সব কাজ হচ্ছে তা নিয়ে আমরা কখনি ভেবে দেখেনি। শুধু তখনি ভেবেছি যখন সেই পরিস্তিতে আমি অথবা আমার রিলেটিভ কেহ পরেছে।

যাইহোক, দুদিন আগে নিশিকন্যার নাম জানতে পেরেছি। কিন্তু এখন ঠিক মনে পড়ছে না। সেই রোগটা এখনও আমায় অবিরাম বিরক্ত করছে। আজকেও নিশিকন্যার বাসায় গিয়েছিলাম। নিশিকন্যা আজ আসার সময় হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। এখনও খুলে পড়া হয় নাই। পড়ব কিনা ভাবছি। আগ্রহটা আরেকটু বাড়ুক, তবেই পরব।

“প্রিয় নীলু”

তুমি অনেক বোকা, আবার হয়তো বোকা না।

সহজ সরল অথবা উদার মনের একজন মানুষ।

আমি জানিনা তুমি কে? জানার ইচ্ছাও করি না।

থাকনা কিছু রহস্য তোমার মাঝে। আমি জানিনা, তুমি কেন আমার প্রতি এত দয়া করছ! জানি না কেন প্রতিরাতে ২০০ টাকা নষ্ট করে আমার পাশে বসে থাকতে? জানিনা তুমি নাপুংশক কিনা। কিছু জানতেও চাইনা।

জানো নীলু, এই শরীরে শত পুরুষের আঁচড় আছে।

কিন্তু এই হৃদয়ে আজও কেউ আঁচড় দিতে পারেনি।

তুমি একমাত্র পুরুষ, যে আমার মনে বিশাল একটা দাগ কেটে দিয়েছে। আমি চাইনা আমি তোমার জীবনে স্থান পাই। কারণ আমার স্থান স্বর্গে নয়, নরকে। তাই চলে যাচ্ছি, দূরে কোথাও।

আসলে কি জানো নীল, নিশিকন্যারা নাপায় এই সমাজে স্থান, নাপায় কোন জীবনে স্থান। পরকাল বলে যদি কোন জীবন থাকে, জানি সেখানেও আমার স্থান হবে না। আমি আজও জানিনা তুমি হিন্দু নাকি মুসলিম অথবা বৌদ্ধ খ্রীস্টান। তবে যদি আমি হিন্দু হতাম, তোমাকে নিশ্চিত দেবতার আসনে বসিয়ে রাখতাম।

আমি মানুষ , কুলাঙ্গার এক মানুষ। কুলাঙ্গার মানুষদের ভালোবাসতে নেই। এটা তাদের জন্য মহা অপরাধ। কিন্তু আমি এই অপরাধটা করব। হয়ত দূর থেকে করব। অথবা আকাশের তারা হয়ে। আর কিছু লিখে তোমাকে বিভ্রান্ত করব না। হয়ত আর দেখা হবেনা।

তাই বলি কি নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন। আর ঐ পার্কে গিয়ে খামোখা আর বসে সময় নষ্ট করবেনা। নিজের জীবন নিয়ে ভাবুন। আর আশা করব, আমাকে ভুলে যাবেন। তুমি করে বলার জন্য অনেক অনেক সরি।

ভালো থাকবেন।

চিঠিটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল। খুব ঘুম পাচ্ছে।

ঘুমে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে চোখ বুঝলেই নিশিকন্যা সামনে এসে দাড়ায়। কি করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ নিশিকন্যার নামটা মনে পড়েছে।

এত পরিচিত নামটা কিভাবে ভুলেছিলাম কে জানে?

সে তো আমার উপরেই আছে। আমার উপরেই তাকে অনুভব করছি।

তার নাম “কদম”

-ওয়াহিদ নীল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *