পর্বঃ- ৫
এক ঘন্টা ধরে আমি থানায় বসে আছি। অনেক আসামীকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক পুলিশ আমার দিকে দু-একবার তাকালে কেউ আমাকে অগ্রাহ্য দেখাচ্ছেনা। আমি হঠাৎ বলে উঠালাম, কেউ আছেন, আমাকে এক কাপ চা দিয়েন। বেশি করে দুধ চিনি দিয়ে কাচা লিকার।
এটা বলতেই সব পুলিশ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বেঞ্চের উপর পা উঠিয়ে কিছুটা আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছি। আর চিনের সেই সম্রাট ভাবছি। আর সকল পুলিশ আমার সেনা এবং থানার দারগা বাবু আমার সেনাপতি।
হঠাৎ ভারী চেহারার সুন্দর একজন পুলিশ আমার সামনে আসলো, চোখে সানগ্লাস। তবে, হতে কোন চাপের কাপ নেই। আসতেই আমি উঠে বসলাম। উনি এসেই আমাকে কিছু প্রশ্ন করলো, আমি হালকা গলায় উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে একজন কনস্টেবল এসে পুলিশের হাতে একটা হালকা নীল রঙের খাম দিয়ে বলল, “স্যার, কুখ্যাত সন্ত্রাসী আঙ্গুল কাটা সিদ্দিক নাকি বেঁচে থাকতে উনার চোখ দুটি একজনকে স্বেচ্ছায় দান করে দিয়ে গেছেন। এইযে দেখুন তার ফর্ম।”
পুলিশ অফিসার চোখ কুঁচকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে বলল, “O my god. একজন ক্রিমিনাল অর্গান ডোনেট করেছে। It’s incredible.” পুলিশটির নাম মতিন। ওনার বুকের উপর ব্যাচে নামটা লিখা। আমি একটু হাল্কা করে বলে উঠলাম, মতিন সাহেব ক্রিমিনালটি যাকে চক্ষু দান করেছে আমি বোধহয় তাকে চিনি।
পুলিশ অফিসার অবাক হলো। কেন অবাক হলো বুঝতে পারছিনা। নাম ধরে ডাকার কারনে হলো নাকি কাকে করেছে সেটা চিনার কারনে হলো সেটা বুঝলাম না। আসলে মানুষ অবাক হলে দেখতে ভালোই লাগে। সে তখন কিছুখনের জন্য একটা যন্ত্রে পরিনত হয়। কিছুটা রোবটের মত।
এর পরদিন খুব কাকা ডাকা ভোরে, আলো ফুটছে এমন সময় আমার ঘুম ভাঙলো রবীন্দ্র সঙ্গীতের আওয়াজে। চোখ মেলে দেখি, সুখী আমার মাথার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে খুব নিচু গলায়। আমি চোখ খুলতে গান গাওয়া বন্ধ করে দিলো।
আমি বললাম, সেই কবে তুমি আমাকে গান শুনিয়েছিলা, ভুলে গেছি দিন গুলোর কথা। আজ অনেকটা দিন পর আবার গান শুনলাম তোমার কন্ঠে। গানটা শেষ করো। সুখী আবার গান শুরু করলো,
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে…
গানটা শেষ করে চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, আগের মত আর সেই বয়স নাই। আগে কতনা সূর দিয়ে গাইতে পারতাম। এখন বেশিখন দম রাখতে পারিনা। আমি বললাম, বুড়ী হয়ে গেছ বুঝি!
-বুড়ি তো তোমার অপেক্ষায় হয়েছি। বিয়েও তো তোমার জন্যই করিনা। বিয়া করবা? চলো আজকে বিয়ে করে ফেলি।
আমি বললাম, আজকে কি বার?
সুখী উত্তর দিলো, আজকে মঙ্গলবার।
-মঙ্গলবার অশুভ দিন। এই দিনে বিয়ে করতে নেই। শেন নুং ও এই দিনে বিয়ে করিনি তার ঝুং মুং কে।
-কি সব বলো। কে এই শেন নুং আর ঝুংমুং?
– তুমি চিনবা না, আমার রাজনৈতিক পাটনার।
সুখী কিছুটা বিরক্ত হলো আমার আজগুবী সব কথা শুনে।
সুখীকে বললাম, সুখী একটা ফোন করবো। তোমার মোবাইল নামক যন্ত্রটা দাও। সুখী বললো, তোমার মোবাইল কই?
-কি জানি। জানি না।
সুখী আবারও বিরক্তি ভরা মুখে তার ফোনটা এগিয়ে দিলো। আমিও মোবাইলটা নিয়ে খালাকে ফোন করলাম।
-হ্যালো, ভালো আছো খালা।
খালার কণ্ঠ খুব-ই উৎফুল্ল।
-তুই এতদিন কোথায় ছিলি নীল? তোর না ফোন করার কথা ছিল? আচ্ছা যাই হোক, তোকে যে শিক্ষক খুঁজতে বলেছিলাম সেটা আর লাগবে না।
-কেন? মেয়ে কি চোখে দেখতে শুরু করেছে।
-তোর সবকিছুতেই ফাজলামি।
-আচ্ছা আর করবোনা খালা।
– কোন একজন মহাত্মা ঐ মেয়েটাকে তার চোখ দুটো দান করে গেছেন! কি ভালো মানুষ!
– তাই নাকি!
– আরে তাহলে বলছি কি! আর অবাক ব্যপার কি জানিস? লোকটা একটা অদ্ভুত শর্ত করে গেছেন, যে তার পরিচয় গোপন রাখতে হবে। কি ভালো মানুষ দেখেছিস নীল। এতো ভালো মানুষও এখন এই পৃথিবীতে আছে।
– আছে খালা আছে৷ নইলে এতো সহজে কেউ চক্ষু দান করে!
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন কেটে দিলাম। আমি মনে মনে কৃতজ্ঞতা অনুভব করলাম সেই পুলিশ অফিসারের প্রতি সিদ্দিক মিয়ার নাম প্রকাশ না করার জন্য। একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসীর শেষ ইচ্ছাটার মূল্যায়ন করা হয়েছে।
মানুষ যতই খারাপ হোক, তার ভিতরে আরেকটা ভালো মানুষও লুকিয়ে থাকে। আমাদের শুধু উচিৎ সেই খারাপ মানুষটার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালো মানুষটাকে খুজে বের করা। কিন্তু, এই সমাজে সবাই খারাপটা খুজে বের করে। ভালো করলেও সেটা চোখে পরে না কারো।
Leave a Reply