পর্বঃ-৩
এখন বিকেল ৪টা বেজে ২৭ মিনিট। আমি নীলক্ষেতের রাস্তা ধরে হাটছি। পিছন পিছন একটা কুকুর আসতেছে বেস কিছুক্ষণ ধরে। আমি দাড়ালে কুকুরটাও দাঁড়ায় আমি হাটলে সেও হাটে। আমি একটু দাড়াই আবার হাটি, আমার একটু দৌড় দেই। আসলে কুকুরটা আমার সাথে এই চোর পুলিশ খেলা ভালোই মেতেছে। আমি আবার মাথা ঝুলাতে ঝুলাতে হাটছি, কুকুরটাও জিব্বা বের করে মাথা দুলাতে দুলাতে পিছন পিছন আসছে।
কড়া রোদে হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যাথা হয়ে আসছে। রাস্তাটা যদি একা চলতো আলাদিনের গালিচার মতো হতো সমস্যা কি হত! গরমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি, আজিমপুরের এই কলনির দিকে মানুষের বসবাস কম। অনেক গাছপালা আছে। আমি রাস্তার পাশেই একটা গাছের নিচে ছায়ায় বসলাম। আমার সাথে কুকুরটাও এসে আমার পাশে বসলো। সেও খুব ক্লান্ত। বলা হয়, গাছ আমাদের পরম বন্ধু। আসলে কিন্তু তা নয়। গাছ আমাদের কৃতদাসের মতো। মানুষ প্রজাতির বন্ধু শুধু মানুষেরাই হতে পারে। গাছের চেয়ে মানুষ সেরা, তাই গাছ তাদের সাহায্যকারী কৃতদাস। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস ভেসে আসছে। একটা কাক আমার পাশে ঘোরাফেরা করছে আর কা কা করে ডাকছে।
হঠাৎ আবার সুখীর দেয়া সেই যন্ত্রটা বেজে উঠলো, কিরিং কিরিং…
পারভিন খালা ফোন করেছে। ফোন ধরতেই…
ঐ পাশ থেকে -হ্যালো
-আসসালামু আলাইকুম খালা।
– আরে নীল, কই তুই? তোরে কতবার ফোন দিয়েছি। তুই ফোন ধরস না। মরছস ঠরছস নাকি!
– না খালা মরমু কেন! আর আগে ফোন করেছিলা বুঝি। কেন কি হয়েছে, এতো জরুরী..!
– শোন, তোকে একজন গৃহশিক্ষক ঠিক করে দিতে হবে।
আমি খালার কথা শুনে খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম। আজকাল ঢাকার প্রতিটা দেয়াল “বাসায় গিয়ে পড়াতএ চাই” এই সব পোস্টারে ভরে গেছে। এর মাঝে খালা একজন গৃহশিক্ষক খুঁজে পাচ্ছে না??
-কি বললে? গৃহশিক্ষক, মানে বাসায় গিয়ে যারা পড়ায়?
– হ্যাঁ, কিন্তু তাকে ইংরেজিতে পারদর্শী হতে হবে এবং শুদ্ধ বাংলা জানতে হবে। আমার ছোটবেলার এক বান্ধবী, বহুদিন পর আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছে। ওর একটাই মাত্র মেয়ে, তাও আবার জন্মাগত অন্ধ। মেয়েটাকে বাংলা লেখা আর বাংলায় কথা বলা শিখাতে হবে। মানি ইজ নো প্রব্লেম। কিন্তু ভালো ছেলে খুঁজে বের করতে হবে।
-এতো খুব প্যাঁচের কাজ। আচ্ছা খালা, আমি তোমাকে ৩ দিন পর জানাবো। পাওয়া গেলেও যাকে-তাকে তো আর তোমার বান্ধবীর মেয়ের জন্য দেয়া যায় না। আজকালকার গৃহশিক্ষকদের চরিত্র খুব খারাপ। পড়াতে গিয়ে প্রেম করে পরে মেয়ে নিয়ে ভাগে।
-এইজন্যই তো তোকে বললাম।
-আইচ্ছা খালা।
– ভুলে যাস নে নীল। তুই তো সব গুলিয়ে ফেলিস।
ফোন রেখে দিলাম। কুকুরটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার সব কথা শুনে হয়তো ভাবছে, এই লোকটা তো মনে হয় বিশাল দ্বায়িত্ববান মানুষ। সবার কাজ খুব দ্বায়িত্ব নিয়ে করে দেয়। কত মানুষ তাকে ফোন দেয়। আমি তার বডিগার্ড হয়েই থাকবো।
আসলে কুকুরটার একটা নাম রাখা দরকার। কি নাম রাখা যায় ভাবছি, আপাতত কোন নামেই মনে পরছেনা। হঠাৎ একটা নাম পরে গেলো। ওর নামঃ- লাল্লু। যেহেতু দেখতে লাল, তাই লাল্লু নামটা বেশ যায় ওর সাথে। লাল্লুকে উদ্দেশ্য করে বলছি, শোন আজ থেকে তোর নাম লাল্লু। কেউ কুত্তা বা কুকুর বললে ডাকে সারা দিবি না। যতক্ষণ না লাল্লু বলে ডাকে। বুঝেছিস। লাল্লু ঘেউ ঘেউ করে উঠলো, তার মানে সে বুঝেছে।
লাল্লু নামটা কোথায় থেকে উৎপত্তি সেটা ভাবতে ভাবতে সেখানেই শুয়ে পরলাম। চারদিকে কেমন যেব ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। প্রচন্ড গরমে এখানে শরীরের শিতল বাতাস বইছে। কেন যেন চোখ দুইটা বন্ধ হয়ে আসছে। আমি সেই গাছের নিচেই ঘুমিয়ে পরলাম।
হঠাৎ লাল্লুর ঘেউ ঘেউ শব্দ ঘুম ভাঙ্গল। একটা মেয়ে চিৎকার দিচ্ছে আর আমার লাল্লু ঘেউ ঘেউ করছে। চোখ খুলতে দেখি, একটা মেয়ে আমার লাল্লুর উপর উস্টা খেয়ে পরেছে। আর সেই জন্যেই লাল্লু ক্ষেপে গেছে। আর লাল্লুর ঘেউ ঘেউ শুনে মেয়েটা ভয় পাচ্ছে।
আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। সৃষ্টিকর্তা কখনো খুঁতহীন সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন না। কিন্তু এই মেয়েটার কোন খুঁত আমি বের করতে পারছি না। খুব অবাক হলাম। এতো সুন্দরও মানুষ হতে পারে। একবার টেলিভিশনে একটা বডি স্প্রের বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম, ওটা গায়ে মাখলে নাকি পৃথিবীর মেয়ে তো কোন ছাড়, পরীরা পর্যন্ত সব উড়ে এসে সামনে উশটা খেয়ে পড়ে প্রেম নিবেদন করে। আমি গায়ের গন্ধ শুঁকলাম, আমার শরীর থেকে তো ঘামের গন্ধ ছাড়া কোন বডি স্প্রের গন্ধ আসছে না। তাই এই সুন্দরী কেন এসে পরলো..!
রূপবতী মেয়েরা অহংকারী হয়। আর সেও এর ব্যাতিক্রম হবেনা। মেয়েটা আমার দিকে না তাকিয়ে আরেকদিকে তাকিয়ে “Help me please, Help me. বলে চিল্লাচ্ছে।
আমি যে তার সামনে বসে আছি। সে দেখেও যেন দেখছে না। নাকি আমাকে পাগল ছাগল ভাবছে কে জানে!
সুন্দরী মেয়ের অভদ্রতার চেয়ে রূপের আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশি হওয়ায় আমি বললাম,
“জী বলুন।”
মেয়েটা আমাকে আবার অবাক করে দিয়ে বলছে,
-I am a blind. I can’t speak in Bangla. Would u help me to reach my home?
আমি ধাক্কা খেলাম। এতো সুন্দর একটা মেয়ে অন্ধ? সৃষ্টিকর্তা তাহলে এই সৌন্দর্যের মাঝেও খুঁত দিয়েছেন। আমি ধাক্কা সামলে জিজ্ঞেস করি- Have u the address with?
– yeah.
ঠিকানাটা দেখলাম, সামনের গলিতেই, আঙ্গুল কাটা সিদ্দিকের বাড়ির পাশেই। আমি মেয়েটার হাত ধরে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফিরলাম। পাঞ্জাবীটা খুলেই আবার ঘুম।
Leave a Reply