পর্বঃ-১
আশেপাশে অনেক শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে আমি কোন বাজারে কৃতদাস হিসেবে আমাকে নিলামে বিক্রি করা হবে। এ নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই । আমি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ধ্যানের মতো বসে আছি। আমাকে নিয়ে দুজন নিলাম ডাকতে ডাকতে গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষন পর হাতাহাতি শুরু হয়ে গেলো। সবাই খুব মজা করে দেখছে। আমিও খানিকটা দেখার জন্য চোখ খুলি। চোখ খুলতেই দেখি সামনে সিলিঙের সাদা দেয়াল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি আমার রুমে ঘুমাইচ্ছিলাম। আর ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখছিলাম।
একবার সুখী বলেছিল, ও ঘুম থেকে উঠে সবার আগে ঘড়ি দেখে, পেন্ডুলাম দুলতে থাকা রাজকীয় ঘড়ি। আমি নীল ওরফে নীলু, তাই সময়ের হিসাব আমি রাখি না। আমি ঘুম থেকে চোখ খুলেই ছাদের দেয়াল দেখি, সিলিং ফ্যান দেখি। আমরা সবাই দেয়ালের মাঝে বন্দি, এই দেয়াল ভেদ করে স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে যাওয়া যায় না। আর আমিও তার ব্যাতিক্রম নই।
বাহিরে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। আর এই হৈচৈর শব্দেই আমি নিলামের স্বপ্ন দেখেছি। বিছানা থেকে উঠে বাইরে গিয়ে দেখি মরুভুমির মতো অবস্থা, পানির জন্য দুই মেস মেম্বারের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেছে। ভাদ্র মাস, এলাকায় পানি নেই। একবেলা সকালে পানি আসে, ঐ সময়ের মধ্যেই সবাইকে যাবতীয় কাজ সেরে নিতে হয়। কে আগে বাথরুমে যাবে এই নিয়ে বাকযুদ্ধ। কিছু করার নেই। আমিও লাইনে দাঁড়িয়েছি, মনে হচ্ছে সামনে রিলিফের চাল দিচ্ছে। সবার হাতে বস্তা। কিন্তু আমাদের কারো হাতে বস্তা নেই। বদনা হাতে দাঁড়িয়ে আছি।
সিগারেট ধরাতেই পেটে মোচড় দিলো, চেপে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। আজ দেশে পানি না খেয়ে কোন মানুষ মারা গেলে সেটা পত্রিকার নিউজ হতো, কিন্তু আমাদের মেসে পানির এমন অভাবে টয়লেটের চাপে কেউ মারা গেলে সেটা পত্রিকায় আসবে না। কারণ এর মধ্যে নাটকীয়তা নেই, আর সব মানুষই নাটকীয়তা পছন্দ করে।
এমন সময় সিদ্দিক মিয়া আসলো, ওকে দেখেই সব চুপচাপ হয়ে গেলো। এলাকার বিশিষ্ট লোক উনি, সংসদ সদস্যের খুব আপনা লোক। অস্ত্রের ব্যবসা করে, আন্ডারগ্রাউন্ডে ব্যপক পরিচিতি পেয়েছে। এলাকায় আসা-যাওয়া করতে হলে সিদ্দিক মিয়াকে সালাম দিয়ে চলতে হয়। অবশ্য সবাই ওনারে আঙ্গুল কাটা সিদ্দিক নামেই চিনে। কিন্তু, কেন ওনারে আঙ্গুল কাটা সিদ্দিক বলে মাথায় ধরেনা। ওনার তো হাতে পায়ে সব আঙ্গুলেই আছে। তবে শুনেছি, উনি একেক জনকে শাস্তি স্ব-রুপ আঙ্গুল কেটে দেন। এই জন্যেই বোধহয়।
সিদ্দিক মিয়া এসে বলল, “নীল ভাই, উইঠা গেছেন? আমি সকাল থেইক্কা আপনের লাইগা বইসা আছি। আইজকা বহুত কথা আছে আপনের লগে। আগে আপনে কাম সাইরা আসেন, আরামে কথা কমু। ঐ, তরা সব যা এখন। নীল ভাই আগে বাথরুম থেইক্কা বাইর হইব, তারপর তরা যাবি। এইখানে হাউকাউ করবি না।” সবাই চলে যায়, আমি বাথরুমে ঢুকি।
বাথরুম থেকে বের হতেই সিদ্দিক মিয়া আমার সাথে আমার ঘরে আসে, ওনার চ্যালাপেলা দিয়ে এর মধ্যেই আমার জন্য নাস্তা আনানো হয়েছে। এরপর খাঁটি গরুর দুধের চা আর একটা বেনসন সিগারেট। আরামে সিগারেট টানতে টানতে বলি, “কি জন্যে খুঁজছিলে ভাই? প্রেমে-টেমে পড়েছ নাকি? আমি কিন্তু এসব আমার কম বুঝি। আমি লাভগুরু না, নীল ওরফে নীলু।”
সিদ্দিক ভাই মাথা চুলকে বলে, “নীল ভাই, একটা বিরাট সমস্যা হইয়া গেছে। আমারে পরী আছর করছে।”
আমি সিগারেট টানতে টানতে বলি, “বুঝলেন কিভাবে? লক্ষন কি?”
“ভাই, প্রথম প্রথম বুঝতে পারি নাই যে ওইটা পরী, ভাবছিলাম মাইয়া মানুষ। ডেইলি বিকালে গাঁজা খাওনের জন্য আমার বাসার ছাদে উঠি। একটা মাইয়া দেখি পাশের বাসার ছাদ থেইক্কা আমার দিকে সোজা তাকাই থাকে, ডেইলি ভাই। আমার রাইতে ঘুম হয় না, চোখ বন্ধ করলেই খালি ঐ মাইয়াটারেই দেখি। ভাই, পরে আমি বুঝলাম যে, ওইটা কোন মাইয়া না, পরী। আমার উপ্রে আছর করছে। মানুষ হইলে তো আর আমার দিকে এইভাবে তাকাইতে পারতো না। এলাকার সবাই আমারে একনামে চিনে “আঙ্গুল কাটা সিদ্দিক”, আমার দিকে চোখ তুইলা তাকানোর কারো সাহস নাই।”
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম- “তাতো অবশ্যই।”
সিদ্দিক মিয়া কাচুমাচু করে বলে, ” ভাই, এইটা নিয়া খুব সমস্যায় আছি, আপনে একটা সমাধান দেন ভাই।”
“হুম, নারী জাতি আসলেই অনেক রহস্যময়। সেটা মানুষই হোক আর পরীই হোক। আমি ভেবে দেখছি কি করা যায়।”
সিদ্দিক মিয়া খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আর বললো, আমি জানতাম নীল ভাই, আপনেই এইটার সমাধান দিতে পারবেন। ভাই তাইলে যাই আজকে। আমি আবার তিনদিন পর আসুম নে।
বলে সিদ্দিক মিয়া চলে গেলো। যাওয়ার আগে কিছু টাকা জোর করে আমার পকেটে দিয়ে গেলো। কচকচা ১ হাজার টাকার নোট। যাক ভালোই হলো, সুখীর সাথে দেখা করতে যাওয়া দরকার কিন্তু, পকেট একেবারেই ফাকা ছিল।
Leave a Reply